শৈশব থেকে পূর্ণ বয়সে পরিনত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কালকে কৈশোর কাল বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১০-১৯ বছর বয়স এই সময়টা হলো কৈশোর কাল। এই বয়সে শারীরিক বর্ধন দ্রুত হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১২-১৫ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১০-১৩ বছর বয়সে বর্ধনের গতি সর্বোচ্চ হয়।
এই বয়সে বর্ধনের গতি বৃদ্ধির কারণে শক্তির চাহিদা বাড়ে, এ ছাড়া প্রোটিন, ভিটামিন ও ধাতব লবণের চাহিদাও বাড়ে। এই বয়সের কিশোর-কিশোরী খেলাধুলা করে তাই তাদের শরীরের বিভিন্ন অংগের সঞ্চালন ঘটে বলে শক্তির খরচ হয়। কিশোর-কিশোরীদের পেশির গঠন, দাঁত, হাড়, রক্ত গঠন ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেশি হয়
কিশোর-কিশোরীর পুষ্টির গুরুত্ব-
- কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক বর্ধন দ্রুত হয় এবং এই বর্ধনের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্তকিলো ক্যালরি বা শক্তিসমৃদ্ধ ও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ।
- এই বয়সে শরীরের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা, পড়ালেখা, বহিরাঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণেরজন্য জীবনের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি শক্তির অর্থাৎ কিলো ক্যালরির প্রয়োজন হয়।
- এই বর্ধিত শক্তিরচাহিদা মেটানোর জন্য কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন হয় ।
- কিশোর-কিশোরীদের ভিটামিন ও ধাতবলবণ সমৃদ্ধ খাদ্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- দাঁত ও হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি কিশোর-কিশোরীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- এই বয়সে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের লৌহ ও ফলিক এসিড বেশি প্রয়োজন হয়। কারণ, মেয়েদের মাসিকের জন্য প্রতিমাসে যে রক্তের অপচয় ঘটে তার পরিপূরণের জন্য অর্থাৎ রক্ত গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় ৷
- কিশোর-কিশোরীদের দেহ ত্বকের ও চোখের সুস্থতার জন্য ভিটামিন- এ, বি ও সি সমৃদ্ধ খাদ্য গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিশোর-কিশোরীর পুষ্টির চাহিদা -
- শক্তির চাহিদা – বর্ধনের গতি বৃদ্ধির কারণে শক্তি বা কিলো ক্যালরির চাহিদা বাড়ে। মেয়েদের চেয়ে -
- ছেলেদের কিছুটা বেশি শক্তি বা কিলো ক্যালরির প্রয়োজন হয়।
- প্রোটিন – কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক বর্ধন দ্রুত হয় এবং এই বর্ধনের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের শক্তি চাহিদার ১২-১৫% প্রোটিন- জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের প্রোটিনের চাহিদা ছেলেদের চেয়ে কিছুটা বেশি হয় ৷
- ধাতবলবণ- কিশোর-কিশোরীদের হাড়ের বর্ধনের জন্য ক্যালসিয়ামের চাহিদা প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে বেশি হয়। হাড়ের যথাযথ বর্ধন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন অবশ্যই ১৫০ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম শরীরে জমা হতে হবে। এই বয়সে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি থাকলে পরবর্তী জীবনে ওস্টিওপোরোসিস দেখা দেওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি বেড়ে যায়। রক্তের হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের জন্য কিশোরীদের লৌহের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মাসিকের কারণে লৌহের অপচয় ঘটে বলে কিশোরদের চেয়ে কিশোরীদের লৌহের চাহিদা বেশি হয়। এই বয়সে জিংকের চাহিদাও বাড়ে। এর অভাবে এই বয়সে শারীরিক স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলোও পরিণতিতে বিলম্ব হতে পারে।
- ভিটামিন— শক্তির চাহিদা বেশি হওয়ায় থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন এবং নায়াসিন-এর চাহিদা বাড়ে। এই বয়সে দ্রুত টিসু সংশ্লেষিত হওয়ার কারণে ফলিক এসিড ও ভিটামিন বি১২ ও বি৬-এর চাহিদাও বাড়ে। মাসিকের কারণে কিশোরীদের ভিটামিন বি১২ চাহিদা বেশি হয়। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কিশোর- কিশোরীদের ভিটামিন ডি প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া এই বয়সে প্রজননতন্ত্রের সুস্থ ও স্বাভাবিক গঠনের জন্য ভিটামিন এ, ই ও সি এর প্রয়োজন হয় ৷
অতএব আমরা দেখতে পাই যে, কিশোর-কিশোরীদের স্বাভাবিক ওজন, উচ্চতা, সুস্থতা এবং পড়ালেখা ও খেলাধুলার ক্ষমতা ও দক্ষতা বজায় রাখার জন্য প্রতিদিন খাদ্যে ছয়টি পুষ্টি উপাদানেরই পর্যাপ্ত ক্যালরি উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে কিলো ক্যালরিসহ প্রয়োজনীয় ছয়টি পুষ্টি উপাদান পেতে হলে খাদ্যের মৌলিক খাদ্য গোষ্ঠীর প্রতিটি গ্রুপ থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য প্রতিদিনই কিশোর- কিশোরীদের নির্ধারিত কিলো ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে।
কিশোর-কিশোরীদের খাদ্য তালিকা তৈরির সময় কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। যেমন-
- কিশোর-কিশোরীদের প্রতিদিন কমপক্ষে তিন বেলা প্রধান খাবার ও দুইবার হালকা নাশতা দিতে হবে। এই বয়সে শিশুরা বেশ দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকে, স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি তারা খেলাধুলাও করে থাকে, ফলে প্রচুর শক্তির খরচ হয়। তাই স্কুলে থাকাকালীন একবার পুষ্টিকর নাশতা দিতে হবে এবং বাসায় আরও একবার নাশতা খাবে। তাহলে অপুষ্টি জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
- প্রতি বেলার প্রধান খাবারে অর্থাৎ সকাল, দুপুর ও রাতের বেলায় মৌলিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
- কিশোর-কিশোরীদের প্রতিদিন প্রয়োজনীয় কিলো ক্যালরির চাহিদা যাতে পুরণ হয় সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শস্য ও শস্য-জাতীয় খাদ্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকতে হবে।
- প্রতিদিনই উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ উভয় উৎস থেকেই প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। দিনে অন্তত একবার প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
- প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ও রঙিন যেমন- হলুদ, সবুজ, লাল, বেগুনি, সাদা ইত্যাদি বর্ণের শাকসবজি ও তাজা টক-জাতীয় ফল অবশ্যই থাকতে হবে।
- সারা দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি গ্রহণ করতে হবে। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য দিনে ৬-৮ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সফট্ ড্রিংকস, জুস, মিষ্টি-জাতীয় খাবার ও তেলে ভাজা খাবার গ্রহণে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে এই খাবারগুলোতে বেশি ক্যালরি থাকে । যারা পরিশ্রমের কাজ কম করে বা একেবারেই করে না বা খেলাধুলা করে না তারা এই খাদ্যগুলো প্রতিদিন গ্রহণ থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে। তা না হলে শরীরের ওজন বেশি বেড়ে যাবে অর্থাৎ ওজনাধিক্যে আক্রান্ত হবে এবং নানা ধরনের জটিল রোগের সূচনা হবে।
- এই বয়সে ফাস্টফুড এর প্রতি প্রায় বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরীরই ঝোঁক থাকে। এই খাবারগুলো কোনো বিশেষ দিন বা উপলক্ষে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে প্রতিদিনই যদি ফাস্টফুড গ্রহণ করে তাহলে খুব সহজেই তাদের শরীরের ওজন বেড়ে যাবে এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা দেবে।
- সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সঠিক খাদ্যাভাসের ব্যাপারে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ায় এমন সব মজাদার ও পছন্দের খাবারের পরিবর্তে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস করতে হবে।
কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী এক দিনের জন্য একটি খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো—
বিভিন্ন শ্রেণির খাদ্য
এক পরিবেশন পরিমাণ
কিশোর (পরিবেশন সংখ্যা)
কিশোরী (পরিবেশন সংখ্যা)
৬-৮
0-8
| শস্য ও শস্য – জাতীয় খাদ্য আধা কাপ ভাত, একটি রুটি, এক টুকরো পাউরুটি।
প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য
৮-৯
৩-৫
একটি ডিম, মাঝারি এক টুকরা মাছ বা মাংস, এক কাপ মাঝারি ঘন রান্না ডাল, আধা কাপ রান্না করা ঘন ডাল, আধা কাপ রান্না মটরশুঁটি, ১/৩ কাপ বাদাম।
শাক-সবজি
এক কাপ কাঁচা সবজি সালাদ, আধা কাপ বিভিন্ন রান্না সবজি, আধা কাপ রান্না শাক, একটা আলু । একটি মাঝারি কলা, পেয়ারা, আম, কমলা,
8-0
৩-৪
ফল
আধা কাপ টুকরা ফল।
৩-৪
-8
| দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্য
এক কাপ দুধ বা দই, আধা কাপ ছানা।
২-৪
3-8
কম ক্যালরি
| তেল ও ঘি
উদ্ভিজ্জ তেল, ঘি, চিনি, গুড় ও বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার।
কম ক্যালরি
চিনি, গুড় ও বিভিন্ন মিষ্টি-জাতীয় ও লবণ-জাতীয় খাবার এই বয়স থেকেই কম গ্রহণের অভ্যাস করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মনে রাখতে হবে বাইরের কেনা খাবারের চেয়ে ঘরে তৈরি খাবার এবং মৌসুমি শাকসবজি ও ফল বেশি পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত। তাই কিশোর-কিশোরীদের এই খাবারগুলো গ্রহণে সচেতন হতে হবে।
কাজ তোমার জন্য একদিনের একটি খাদ্য তালিকা তৈরি কর।